Sunday, 24 September 2023

উগ্র ধর্মীয় বিষবাষ্পের তাড়ন ও আমাদের উৎকণ্ঠা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কায় জাতের বড়াইকে দেখিয়েছেন তাঁর কবিতায়।

Editor: Md Shovon Khan
Saturday, 06 November 2021 3619

“ জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহন-শীল,
তাকে কি ভাই ভাঙ্তে পারে ছোঁয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল!
যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত, আজ নয় কা’ল ভাঙবে সে ত,
যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া”।
(জাতের নামে বজ্জাতি সব -কাজী নজরুল ইসলাম)

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কায় জাতের বড়াইকে দেখিয়েছেন তাঁর কবিতায়। কালে কালে দেশে দেশে জাতে জাতে যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে হারিয়েছে অনেক মানুষের প্রাণ। ধর্মীয় রেষারেষিতে নানা সময়ে বলি হয়েছে অনেক মানুষ , ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে অনেক সভ্যতা। কালের বিবর্তনে জাতের বড়াইয়ের ভিন্নতা পেয়েছে কখনও বংশের, কখনও অর্থের, কখনও শিক্ষার আবার কখনও ধর্মের মোড়কে। এই মোড়কের বিষবাষ্পের দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে উগ্রবাদীর বিষবাষ্পের উদাহরণ হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে মাঝে মাঝে হানা দিয়েছে উগ্রধর্মীয়বাদের খড়গহস্ত। শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বহু মানুষকে শিকার হতে হয়েছে হত্যার এবং নৃশংসতার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় উগ্রধর্মীয়বাদীদের হানায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেক নিরাপরাধ মানুষ। ধর্মীয় পরিচয়কে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । ধর্ষণের মত ন্যাকারজনক অন্যায়কেও মুড়ে দেয়া হয়েছে ন্যায়ের চাদরে। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের রচিত ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থে উল্লেখিত বীরাঙ্গনাদের সাক্ষ্যে স্পষ্টত পাওয়া যায়, রাজাকাররা ‘গনিমতের মাল’ বলে আখ্যা দিয়ে বাঙালি নারীদেরকে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানিদের হাতে। নারীদের ‘গনিমতের মাল’ আখ্যা দিয়ে গণধর্ষণকে বৈধতা দিতে চেয়েছে । অথচ, এই গনিমতের মালের রয়েছে একটা সুন্দর অর্থ। উগ্রধর্মীয়বাদের বিষবাষ্প একটি ইতিবাচকতাকে করেছে নেতিবাচক। ১৯৭১ সালের ধর্মকে ব্যাবহার করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের নির্যাতনের ছককেও সাজিয়েছে। ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিধেয় বস্ত্রকে বিবস্ত্র করেছে। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ এবং ইসলামধর্মের নামকে ব্যাবহার করে অন্যান্য ধর্মের উপর চালিয়েছে হামলা , জ্বালাও- পোড়াও, হত্যা, লুটতরাজ এবং নানা হীনকর্ম । ইসলাম ধর্মের মূল বার্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে উগ্রধর্মীয়বাদকে পুঁজি করে মানুষকে হত্যা এবং জানমালের ধ্বংসের নেশায় মত্ত হয়েছিল পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের দোসররা। পাকিস্তানের এই উগ্রধর্মীয়বাদের মতকে মিশিয়ে দিয়ে বাঙ্গালীদের সাহসিকতায় বাঙালি জনসাধারণের মূল চেতনার ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হিসেবে উত্থান ঘটে বাংলাদেশের । প্রায় ৩০ লক্ষ শহী্দদের এবং ০২ লক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে পরিচিতি পায় ধর্ম নিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে। হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডের মানুষ ছিল সবসময় ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার। তারই একটি উদাহরণ পাওয়া যায় নজরুলের কবিতায়। তিনি লিখেছেন, “শাঁখের সুর আযানে যাচ্ছে মিশে, ধর্মান্ধ তোমার লালসা মিটবে কিসে”।

এটাই চিরাচরিত বাংলার রূপ। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সকল ধর্মের মানুষের থাকে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। উগ্রধর্মীয়বাদীরা এবং ধর্ম বাবসায়ীরা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দকে নিয়ে খেলছে অপব্যাখ্যার খেলা। তাদের সমীপে মোক্ষম জবাব বঙ্গবন্ধুর জবানীতে স্পষ্টত । ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার স্পষ্টত ব্যাখ্যা । তিনি বলেছিলেন- ‘…আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’(দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ মার্চ, ২০২০)।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব এসেছে সৌদি বাদশা ফয়সালের থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে । বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন দৃঢ়তার সাথে। ১৯৭৩ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অধিবেশনে অংশগ্রহণের সময় বঙ্গবন্ধু এবং সৌদি বাদশা ফয়সালের মধ্যকার কথোপকথনে অংশ ছিল এমন-

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এক্সিলেন্সি, আপনি জানেন এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিচ্ছে না?’ জবাবে বাদশা ফয়সাল বলেন, ‘আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও কাছে জবাবদিহি করি না। তবু আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি— সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে”। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই শর্ত অন্তত বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম রয়েছে। সবাই একইসঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে। তাছাড়া এক্সিলেন্সি, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে— পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তো শুধু ‘মুসলেমিন’ নন, তিনি হচ্ছেন ‘রাব্বুল আলামিন’। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা।“ (সারাবাংলা.নেট , ৩০ আগস্ট ২০২১)।

বঙ্গবন্ধু সবসময় এই রাষ্ট্রকে পরিচয় করিয়েছেন ধর্ম নিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে। তবে বিভিন্ন সময়ে ধর্মব্যবসায়ী , ভণ্ড এবং উগ্রবাদীরা ধর্মের দোহায় দিয়ে বাংলাদেশের উপর আঘাত হেনেছে। চেষ্টা করেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্টের। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের রোষানলে পড়েছে নানা ধর্মের উপাসনালয়, লোকালয় এবং জনজীবন। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার হয়েছে ধর্মীয় স্থাপনা, বাড়িঘর, জীবন জীবিকার উৎস। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ পল্লিতে হামলা চালিয়ে ১৯ টি বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস যজ্ঞে পরিণত হয়। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবরের নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে এসে উগ্র ধর্মীয়বাদীদের থাবা । এক ধর্মীয় নেতার বিপক্ষে কটুক্তির অভিযোগে গত ১৭ মার্চ, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের হবিবপুর নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা হয় । ২০২১ সালের ৭ই আগষ্ট খুলনার রুপসায় হিন্দু অধ্যূষিত গ্রাম হামলার শিকার হয়। নানা সময়ে বিশেষ করে হিন্দুদের বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ভেসে আসে ভাঙ্গামূর্তির ছবি। উগ্রধর্মীয়বাদীদের নিকৃষ্ট চিন্তার মধ্যে লালিত থাকে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের।

২০২১ সালের এই ডিজিটাল, আধুনিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে এসেও দেখতে হয় উগ্র ধর্মীয়বাদের রক্তচক্ষুর রাঙালি। গত ১৩ অক্টোবর ২০২১ সালে কুমিল্লা শহরের নানুয়ারদীঘি এলাকার একটি পূজামণ্ডপের প্রতিমায় কোরআন রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে অবমাননার অভিযোগ এনে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে বলে জানায় সেখানকার একজন ধর্মীয় নেতা। তবে বলা বাঞ্ছনীয়, যে বা যারা পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখেছে তাদেরকে খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গত ১৫ অক্টোবর ২০২১ সালে নোয়াখালীর চৌমুহনীর পূজামণ্ডপে তাণ্ডব চালায় । কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়াকে কেন্দ্র করে সহিংসতার দু’দিন পর ১৫ অক্টোবর চৌমুহনীর মণ্ডপ আর মন্দিরে যে হামলা হয়েছে, তাতে জীবন গেছে দু’জন মানুষের। (বিবিসি বাংলা, ২০ অক্টোবর ২০২১)। গত ১৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে রংপুরের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়ার এক হিন্দু কিশোর ইসলাম ধর্মকে ‘অবমাননা করে ’ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে৷ সত্যতা যাচাই না করে উগ্রধর্মীয়বাদীরা মেতে ওঠে ধ্বংসের ও রক্তের খেলায়। রংপুরের পীরগঞ্জ রামনাথপুর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে হামলাকারীদের দেয়া আগুনে পুড়ে গেছে হিন্দুদের ২৫টি ঘরবাড়ি৷ মন্দির ভাংচুরসহ ঘরবাড়ি-দোকানপাট লুটপাট করা হয়েছে। ( ডি ডব্লিউ, ১৮ অক্টোবর ২০২১)।

কোন ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের অন্যায়কে পুরো জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়া মানবতার চরম অবমাননা।ভিত্তিহীন, মিথ্যা, উড়ো গুজবের উপর ভিত্তি করে অন্য ধর্মের উপর হামলা চালানো কোন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। যদি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকে তাহলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার শাস্তির ব্যবস্থা করবে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। যে ঘটনাগুলোর উপর ভিত্তি করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে , সেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য গভীর ষড়যন্ত্র। এই ধরণের উগ্রবাদীতার ফলে বিতর্কের মুখে পড়ে পুরো ধর্মীয় ব্যবস্থা। এই উগ্রধর্মীয়বাদের বিষবাষ্পকে বিনাশ করতে হবে, উপড়ে ফেলতে হবে উগ্রধর্মীয়বাদের শিকড়কে। এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যাতে কোনভাবেই উগ্রধর্মীয়বাদের বিষবাষ্পের কারণে কলুষিত না হয় সেদিকে রাখতে হবে সজাগ দৃষ্টি। উগ্রধর্মীয়বাদের তাড়নে যেন বিনষ্ট না হয় হাজার বছরের ‘অসাম্প্রদায়িক” পরিচয়ের এই ভূখণ্ডের গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়ের। মনে রাখতে হবে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’, ‘ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ সবার’।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্প্রীতি