Monday, 04 December 2023

ডলারের বাজারে হঠাৎ আগুন

Editor: CanBangla
Wednesday, 18 May 2022 14942

অনলাইন ডেস্ক : আমদানিতে বিরূপ প্রভাবে দ্রব্যমূল্য দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা, খোলাবাজারে ১০০ টাকার বেশি আরও বৃদ্ধির আভাস, সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ, তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ পরিস্থিতি

হঠাৎ করেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরেই চলে গেল ডলারের বাজার। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। দফায় দফায় রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে ডলার ছেড়ে তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। ফলে অনেকটা হঠাৎ করেই ডলারের বাজারে আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বাংলাদেশি মুদ্রার বিপরীতে প্রতি ডলারের দাম এক লাফে গতকাল এক শয় উঠেছে। ক্রেতা ও মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, কার্ব মার্কেটে (খোলা) কোথাও কোথাও প্রতি ডলার ১০০ থেকে ১০২ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। ডলারের হঠাৎ এ দরবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে ব্যাংক। ডলার বিক্রি করেই বড় মুনাফা করছে তারা। ডলারের বাজারে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা এলসি খুলতে ৭৫ শতাংশ অগ্রিম দিয়েও ডলার পাচ্ছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক ও খোলাবাজারে ডলারের দরে পার্থক্য ১৩ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। এটা পুরোপুরি অস্বাভাবিক বলছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিতে গন্ডগোল রয়েছে। এমনকি এতে স্বচ্ছতারও অভাব রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারে দরের পার্থক্য কমিয়ে আনারও পরামর্শ দিয়েছেন। একই ডলার ফরমাল মার্কেটে এক দর আর ইনফরমাল মার্কেটে আরেক দর। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এবং এটা কোনো নীতির মধ্যেই পড়ে না বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

অনেকে অভিযোগ করেছেন, সিন্ডিকেট করে ডলারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটের সংশ্লিষ্টরা ব্যবসা করার জন্য ডলারের দর বাড়াচ্ছেন। কিছু ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বিশাল অঙ্কের মুনাফা করছে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দর ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এ দর নির্ধারণ করেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে। ব্যাংকগুলো বাস্তবে এলসি খুলতে ডলারে দর রাখছে ৯২-৯৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলারে ব্যাংকগুলোর মুনাফা হচ্ছে ৫-৬ টাকা। খোলাবাজারে বিক্রি করছে ৯৭-৯৮ টাকায়। এখানে মুনাফা করছে ৯-১০ টাকা। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দর বেড়েছে ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। ডলার সংকটের কারণে খোলাবাজারে সাধারণ ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১০১ টাকা দরে। কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি দাম দিতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের এ অস্থিরতার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমদানি বাণিজ্যে। যার কারণে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দর আরও বাড়বে। এখনই বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহের পরামর্শও করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সেটা হবে সাময়িক সমাধান। স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের জন্য নীতির জায়গাটা আগে ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরও অধিক কার্যকর ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাজারে তদারকি বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পর আমদানিতে বড় ধরনের চাপ পড়ে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দর বৃদ্ধি পায়। দাম বাড়ে খাদ্যপণ্যের। ফলে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া জ্বালানি, খাদ্যপণ্য, ভোজ্য তেল কিনতে ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়। করোনার পর রেমিট্যান্সে প্রবাহ কমে যায় বাংলাদেশে। আমদানির চাপ, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় চাহিদামতো ডলার সরবরাহ কঠিন চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, অন্যদিকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক কম হওয়ায় সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে বাংলাদেশের রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়ে। মাত্র মাসখানেকের ব্যবধানে ৪৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৪১ বিলিয়ন ডলারে। যা প্রতিদিনই কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ও ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য (অথরাইজ ডিলার-এডি) শাখায় ডলার বিক্রি করেও কোনো নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। প্রায় প্রতিদিনই ডলার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে দফায় দফায় ডলারের দর (ব্যাংক রেট) সমন্বয় করা হয়েছে। অবমূল্যায়ন করা হয়েছে টাকার মান। এর পরও নিয়ন্ত্রণ আসেনি ডলারের বাজার। খোলাবাজারে ডলারের দাম আবারও বেড়েছে। গতকাল দেশে প্রথমবারের মতো ডলারের দর ওঠে ১০১ থেকে ১০২ টাকায়। আগের দিনও খোলাবাজারে ৯৭-৯৮ টাকা দরে ডলার বিক্রি হয়। বাংলাদেশে এর আগে কখনো ডলারের দর ১০০ টাকা অতিক্রম করেনি। আমদানিতে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির পর থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকালও ১০ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলে চলতি অর্থবছরের ১৬ মে পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে ৫২১ কোটি ৬০ লাখ।

করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেলসহ সব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। চাহিদা বাড়ায় চলতি অর্থবছরে পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন পণ্যের এলসি বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। ফলে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ডলারের যে পরিমাণ চাহিদা, বিপরীতে ডলার আহরণের উৎস সে অনুযায়ী হয়নি। যেখানে আমদানি বেড়েছে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি, রপ্তানি সেখানে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে প্রতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে প্রবাসীরা পাঠালেও এ বছর সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। ঈদ উপলক্ষে কিছুটা বাড়লেও সাত-আট মাস ধরে প্রতি মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না বাংলাদেশ।