খরচ বাড়ছে হৃদরোগ চিকিৎসায়
Editor: CanBangla
Wednesday, 01 March 2023 193

অনলাইন ডেস্ক : ডলারের বাড়তি দামের অজুহাতে দাম বাড়ানো হচ্ছে হৃদরোগ চিকিৎসা সরঞ্জামের। জীবনরক্ষাকারী রিং ও পেস মেকারসহ প্রতিটি সরঞ্জামে ১৪ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) অনুমোদনের ভিত্তিতে আজ বুধবার থেকে এই বাড়তি দাম কার্যকরের কথা রয়েছে। তবে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কার্ডিওলোজিস্টরা। তারা বলছেন, এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত রোগীরা চরম বিপাকে পড়বেন।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের দাম যতটুকু বেড়েছে, তার তুলনায় সরঞ্জামের দাম অনেক বেশি বাড়ানো হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন যাচাই-বাছাই না করেই এসব অনুমোদন দিয়েছে বলেও দাবি তাদের। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘কী কারণে বাড়ানো হচ্ছে বিষয়টি খোঁজ নেব। তার পর বলতে পারব।’
গত বছরের মে মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হোন ফরিদপুরের তমিজ উদ্দিন। পরে তাকে ফরিদপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যালে নিলে এনজিওগ্রামে ৭০ শতাংশের বেশি ব্লক পান চিকিৎসকরা। রিং পরানোর পরামর্শ দেওয়া হয় তাকে। গত রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তির হার্টে দুটি রিং পরানো হয়। এতে খরচ হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা।
তার ছেলে জহিরুল ফকির বলেন, ‘ভাগ্য ভালো আমরা দাম বাড়ানোর আগেই নিতে পেরেছি। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক জানান ১ মার্চ থেকে দাম বাড়বে।’
তবে বাড়তি দাম দিয়েই রিং নিতে হবে কিশোরগঞ্জের জামিল হোসেনকে (৫২)। রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে আগামী সপ্তাহে তার রিং পরানোর কথা রয়েছে। তার স্ত্রী মৌসুমী বেগম বলেন, ‘বর্তমানে ৭২ হাজার টাকা হলেও আগামী সপ্তাহে হওয়ায় সেটি ৮২ হাজার টাকা চেয়েছে এক কোম্পানি।’
ডিজিডিএ সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলার সংকট প্রকোট আকার ধারণ করলে মেডিক্যাল ডিভাইস আমদানিতে স্থবিরতা নামে। এলসি জটিলতায় আটকে যায় বহু জীবরক্ষাকারী সরঞ্জাম। বিষয়টিকে সামনে রেখে চলতি বছরের শুরুতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জানুয়ারির শেষের দিকে প্রস্তাবের অনুমোদন দেয় ডিজিডিএ।
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে বোস্টন সায়েন্স, মেরিল সায়েন্স ও কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেডসহ স্থানীয় বেশ কিছু কোম্পানি। এসব কোম্পানি বলছে- বর্তমানে প্রতিটি সরঞ্জাম আমদানিতে খরচ ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। লোকসান কুলিয়ে উঠতে না পারায় দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন দাম অনুযায়ী, এতদিন যে রিংয়ের দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, সেটি এখন নিতে হবে ৮২ হাজার টাকায়। একইভাবে এক লাখ ৮ হাজার টাকার রিং এক লাখ ৩৫ হাজার এবং দেড় লাখ টাকার রিং পেতে গুনতে হবে এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা। আবার যে পেস মেকারের দাম এতদিন ৯৫ হাজার টাকা ছিল, এখন তা নিতে হবে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে আগে যেখানে ছয় কোটি টাকার ডিভাইসের জন্য এলসি খোলা যেত, বর্তমানে হচ্ছে দুই কোটির মতো। আবার ডলারের দামও চড়া। তার পরও এতদিন লোকসান দিয়েই আগের দামই নেওয়া হচ্ছিল। এখন বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে।
ডিজিডিএ সব কিছু বিবেচনায় দাম বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে বলে দাবি করেন বোস্টন সায়েন্সের কর্মকর্তা মো. মনির। তিনি বলেন, ‘ডলার দামের পার্থক্য ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে খরচ বাড়ায় দাম বাড়াতে হচ্ছে।’
চিকিৎসকরা জানান, দেশে প্রতিমাসে আড়াই থেকে তিন হাজার রিং এবং প্রতিবছর ২৬০টির মতো পেস মেকার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পরানো হয় সরকারি হাসপাতালে। হৃদরোগ রোগীদের চিকিৎসায় সরকারিভাবে সবচেয়ে বড় ও প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। যেখানে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের মতো রিং পরানো হয়। প্রতিবেশী ভারতে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে রোগীদের রিং দেওয়া হলেও বাংলাদেশে সামান্য পরিমাণে পান রোগীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের কিনতে হয়।
ইনস্টিটিউটের এক সহযোগী অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দাম বাড়ানোর পেছনে ডিজিডিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদা কোনো যোগসাজশ থাকতে পারে। এটি সমন্বয় করার কথা বলা হলেও পারতপক্ষে বেশি মনে হচ্ছে। যা গরিব রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টকর।’ তিনি বলেন, ‘সরকার চাইলে হৃদরোগের এই চিকিৎসা সরঞ্জাম বিনামূল্যে দিতে পারে। কারণ ভারতে এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি হাসপাতালে রিং বিনামূল্যে পান রোগীরা। রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী এতে সরকারের মাত্র ৪ কোটি টাকা খরচ হবে।’
হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিনের দাবি- আগে যে কোনো সরঞ্জামের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে ডিজিডিএ তাদের সঙ্গে আলোচনা করত। কিন্তু নতুন দাম বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।
ডিজিডিএর পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ডলারের উচ্চমূল্যে বিষয়টিকে সামনে এনে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। যেহেতু সব কিছুর দাম বেড়েছে, তাই সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে দাম বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান (রতন) বলেন, ‘সব কিছুর দামই এখন চড়া। ফলে আমদানিকারকদের খরচ বেড়ে যাওয়ায় হয়তো দাম বাড়ানো হচ্ছে। তবে রোগীদের জন্য এটি আরও সংকট তৈরি করবে।’
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. জামাল উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘এর আগে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্রারিক্ত দাম বাড়িয়েছিল, পরে সেটি কমানো হয়। এবারও তাই হয়েছে কিনা খোঁজ নেব।’